মনে করি আসাম যাবো (পর্ব ৩)
পর দিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ম্যাগি আর চা খেয়ে নিলাম। জোসেফ দাদা খুব রসিক মানুষ। তিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন গাইড করে। মোস্তাককে দেখলেই গান গেয়ে উঠছেন, যো ওয়াদা কিয়া বো নিভানা পারেগা!
একদম ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। পুরোই বান্দরবানের স্বাদ। তেমনই ঝুরঝুরে মাটি, বাঁশঝাড়, ডালপালা কেটে কেটে এগোনোর রাস্তা মিলে দারুণ একটা ট্রেইল। এর মাঝে কিছু গাছে ভালুকের থাবার ছাপ দেখালেন দাদা। ভালুক এই গাছটার ফল খেতে আসে। কপাল খারাপ থাকলে সাক্ষাৎ হয়ে যেতে পারে।
গল্পগুজব করে করে চূড়ায় যখন পৌঁছাই, দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। জোসেফ দাদা জানান, এই চূড়ার নাম ‘থিং তুহ বুং’। থিং অর্থ কাঠ, তুহ অর্থ কুঠার দিয়ে আঘাত করা আর বুং অর্থাৎ পাহাড়। কুঠার দিয়ে আঘাত করে কাঠ কাটার পাহাড়। গুগলে বলে এই চূড়ার উচ্চতা মোটামুটি ১ হাজার ৯৬০ মিটার। দাদা দেখলাম তেহজীবকে নিয়ে খুব গর্বিত। বারবার বলছিলেন, ‘আরে প্রীতি তো বহত আচ্ছা চালতি হ্যায়! থাক নেহি যাতি? ইয়ে তো আগে চালনে লাগি! পেহলি বার কোই বাচ্চি আয়ি হ্যায় ইস পাহাড়মে…।’ তেহজীবের ডাকনামটাই ওদের বলেছিলাম, প্রীতি।
চূড়া থেকে আশপাশে তাকালে মনিপুর, নাগাল্যান্ডের পাহাড়গুলো দেখা যায়। ভিউ খুব ভালো পাওয়া যাবে না জঙ্গলের জন্য। মানুষ যাওয়া শুরু করলে হয়তো চূড়া পরিষ্কার করবে ওরা। তবে এত সুন্দর একটা ট্রেইলের জন্য আসলে যাওয়া উচিত।
আধা ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে, ছবি ভিডিও তুলে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। বেচারা দাদার ম্যাগি খেয়ে হাঁটতে নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে। ওরা সকালে ভাত খেয়ে অভ্যাস। নিচে নামতে সাড়ে ১২টার মতো বেজে গেল। এসে দেখি দিদি রান্না শেষ করে খেতে ডাকছেন। আজকের মেন্যু কলার মোচার সাথে আলু আর ডাল দিয়ে ঝোল এবং আমাদের জন্য ডিম। বললে ওরা মুরগির ব্যবস্থাও করত। কিন্তু যার ডাকে গ্রামে পৌঁছাতে পারলাম তাকে খেয়ে ফেলাটা ঠিক মনে হচ্ছিল না। যাই হোক, পাহাড়ে সব খাবার আমাদের ভালো লাগে, সব!
আমরা খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। জোসেফ দাদা আমাদের সেইকলের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। সেইকল এই গ্রাম থেকে ৪০ মিনিটের পথ। তিনি একটা কাজে যাচ্ছেন পিলেকুল। বললেন, এখানে তোমরা একাই যেতে পারবা। সূর্যাস্ত দেখে ফিরে এসো।
তেহজীব কিছুক্ষণ পুইপুই আর পাশের বাড়ির আরেকটা বাচ্চার সাথে খেলা করলো। ওই বাচ্চাটার নাম আইলম। তাকে অরেঞ্জ জুস খেতে দিলো মোস্তাক। ওর কিছু ভালো লাগলে 👍 (থাম্বস আপ) করে দেখায়। পাহাড়ি বাচ্চাগুলো এত মিষ্টি হয়!
আমরা ২টার দিকে আবার বের হলাম। সেইকলের রাস্তা দু’টি। একটা আমরা গ্রামের দিকে আসার পথে যেটা দেখেছিলাম আগের দিন। আর আরেকটা গ্রামের ভেতর দিয়ে, যেটায় এখন আমরা যাচ্ছি। এই ট্রেইলটাও সুন্দর। তবে একদমই তৈরি রাস্তা আর কি। কারণ মানুষ এখানেই আসে। মাউন্ট সেইকল হচ্ছে তৃতীয় চূড়া। এই চূড়ার নামকরণের পেছনেও সুন্দর একটা গল্প আছে। ‘সেই’(seil) অর্থ হচ্ছে মিঠুন। এই মিঠুনকে বলা যায় ষাঁড়ের আরেকটা প্রজাতি। আমরা গ্রামে আসার পথে তোরণে যে ষাঁড়ের মাথার আকৃতি দেখেছিলাম, সেটা এই মিঠুনেরই ছিল। আর ‘কল’(kal) অর্থ চূড়ায় আরোহন বা climbing। বহুদিন আগের কথা। তুমজাং গ্রামের একজন স্বপ্ন দেখেন যে তাকে কেউ বলছে, নিচে থেকে একটা মিঠুন পাহাড় চূড়ায় উঠে আসবে পাশের রাজ্যের রাজকন্যাকে নিয়ে। ওর সাথে তোমাদের গ্রামের রাজপুত্রের বিয়ে দেবে। মিঠুনটাকে যেন মারবে না। সেই লোক স্বপ্ন দেখে দলবল নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে থাকে। সত্যি সত্যি এক মিঠুনকে পাহাড় আরোহন করে আসতে দেখা যায়। রাজকন্যা ছিল কিনা জানা যায়নি। ওই লোক মিঠুনটাকে মেরে ফেলে। তারপর লোকজন নিয়ে সেটা রান্না করে খেয়েও ফেলে। যারা খেয়েছে কেউ পরবর্তীতে বাঁচেনি। সেই থেকে এই চূড়ার নাম মাউন্ট সেইকল।
চূড়ার ওপর একটা ভিউপয়েন্ট করা আছে। বসে আড্ডা দেয়া যায়। চূড়ার কাছে চারপাশটা দেখতে জ্যুকো ভ্যালির মতো। বর্ষায় সবুজ থাকে, তখন বেশি সুন্দর লাগে। আমরা দেখছিলাম সোনালি। পাহাড় সবরূপেই সুন্দর। চূড়ায় উঠে বসে ছিলাম বেঞ্চিতে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছিল। সূর্যাস্ত পর্যন্ত টেকা মুশকিল হয়ে যাবে। কাঁপাকাঁপিতে অস্থির হয়ে শেষে নেমেই আসলাম।
একটু আগেই চলে আসায় ভাবলাম গ্রামটা ঘুরে দেখি। তুমজাং গ্রাম বেশ বড়। গ্রামে বাচ্চাকাচ্চা কম। একটু বড় হলেই সবাই শহরে চলে যায়। গোটা গ্রামে একটা গির্জা, একটা স্কুল এবং একটা দোকান ঘর আছে। দোকানটা আবার জোসেফ দাদার ভাইয়ের বউ চালান। পাহাড়ে তো নারীরাই কাজ করেন। আমরা দোকান থেকে কেক, বিস্কুট কিনে নিজেরা খেলাম আর বাকিগুলো কিমবয় দিদি আর দাদার জন্য দিলাম। সন্ধ্যায় বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তারা দেখলাম।
তবে এখনো বান্দরবানের পাহাড় থেকে দেখা সেই সপ্তর্ষি আমার কাছে সেরা। ঠান্ডায় হিম হয়ে ঘরে ঢুকে কম্বল নিয়ে শুতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। দাদার ফিরতে রাত হলো অনেক পিলেকুল থেকে। উনি এসে আমাদের ডাক দিলেন যখন রাত বাজে ১০টা। দিদি আগেই খেয়ে পুইপুইকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ওহ! রাতের মেন্যু তো বলাই হলো না।
রাতের খাবারে ছিল আলুভাজা আর পিলেকুল থেকে আনা ক্যানড টুনা ফিশ যেটা দাদা এসে রান্না করেছিলেন আমাদের জন্য। গরম গরম খেতে খুবই ভালো ছিল। আমাদের খাইয়ে, সব গুছিয়ে সুন্দর করে ঘরটা ঝাঁট দিয়ে আসন পেতে বসে দাদা গল্প করলেন। সেই রাতেও অনেক গল্প হলো। আজকে এই গ্রামে শেষ রাত।
লেখা : তামান্না আজমী