মনে করি আসাম যাবো (পর্ব ২)

abc

ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উঠে গেলাম। রাতেই বলা যায় তৈরি হয়েই শুয়েছিলাম। ভোরে উঠে শুধু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশন যেহেতু হোটেলের পাশেই, তাই চিন্তা ছিল না। ভোরের আধো আলো আর অন্ধকারে রাজকীয় স্টেশনটা আরো সুন্দর দেখাচ্ছিল। হামসাফার এক্সপ্রেসের এসি স্লিপার টিকেট করা ছিল। আগরতলা থেকে বেঙ্গালুরু যায় এই ট্রেন।

আমরা সাত ঘণ্টার জার্নি করব কেবল। নিউ হাফলং নেমে যাব। ইন্ডিয়ার ট্রেনগুলো বাইরের দিকটা নানারকম নকশা করা ওয়ালপেপার লাগানো থাকে। আর ট্রেনলাইন আঁকাবাঁকা হওয়ার ফলে জানালা দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় যে ট্রেন সাপের মতো বাঁক নিয়ে চলছে। মোস্তাক আমায় তা ডেকে নিয়ে দেখাল। সে এক দৃশ্য! আগরতলা থেকে হাফলংয়ের এই জার্নিটা সুন্দর। পাহাড় দেখা যায় প্রচুর।

সকালের নাস্তায় ট্রেনের ব্রেড-ওমলেট আমার খুব পছন্দের। তবে চা একদম যা-তা। সকালে এক কাপ খেতেই হয়, তাই উপায় নেই। ট্রেন বেশ ফাঁকা ছিল। আমরা তিনজনই ছিলাম শুধু অনেকটা সময়। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে বসে পৌঁছে গেলাম হাফলং। স্টেশনটা ঠিক যেন পাহাড়ের কোলে। যেদিকে তাকাই পাহাড় দেখা যায়। স্টেশনের বাইরে অটোরিকশা অপেক্ষায় থাকে। এবার আমাদের লক্ষ্য আসামের সর্বোচ্চ চূড়া। তার জন্য যে গ্রামে যেতে হয়, তার নাম পিলেকুল। বেসক্যাম্প বলা যায় আর কি।

একে ওকে জিজ্ঞেস করছিল মোস্তাক কিভাবে যাওয়া যায়। এক লোক ছিলেন ওখানে বাঙালি, উনি তার পরিচিত এক অটোওয়ালার সাথে কথা বলিয়ে দিলেন। সেই অটোওয়ালা ভাই প্রথমে কিছুতেই নেবেন না আমাদের। পিলেকুলে এখন যাওয়া যাবে না, ওখানে ল্যান্ডস্লাইড হচ্ছে, বিপদের আশঙ্কা আছে। টাকা দিলেও সে যাবেন না। আমাদের অহেতুক টাকা খরচ হবে এটা উনি মানতে নারাজ। এদিকে আমরা এত ঝামেলা করে গিয়েছি ফিরে আসব বলে নাকি?

শেষে নিজেদের রিস্কে যাচ্ছি, আপনি শুধু রাস্তা বলে দেবেন, অনেক দূর থেকে আসছি, এসব বলে রাজি করানো গেল। লোকটা খুবই ভালো। নাম গুপ্তরাজ। খুব দ্রুত ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা বলছিলেন। ঘণ্টাখানেক চলার পর আমরা পৌঁছালাম মাহুর বলে একটা জায়গায়। মাহুর হচ্ছে আসামের ডিমা হাসাও জেলার একটা শহর।

মাহুরে বড় বাজার বসে। আশপাশের সব গ্রামের মানুষজন এই মাহুরেই আসে জিনিসপত্র কিনতে। মাহুরে অটো দাঁড় করিয়ে গুপ্তরাজ দাদা নেমে পড়লেন। উদ্দেশ্য কাউকে খুঁজে পাওয়া, যে কিনা আমাদের বিকল্প রাস্তাটা চিনিয়ে দেবেন। মোস্তাকও নামে। আমি আর তেজু বসেই ছিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর একজনকে পাওয়া গেল। পরে জেনেছিলাম, ওনার নাম হচ্ছে বেম। উনি নিজের বাইক নিয়ে আমাদের অটোর সাথে যাচ্ছিলেন।

আরো প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা একটা বড় রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। রাস্তাটার কাজ চলছে। বেম দাদা আমাদের দেখালেন সামনে এগোলেই পিলেকুল। আর রাস্তার পাশ দিয়েই ওপরে উঠেছে একটা রাস্তা, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। আমাদের ওদিকেই যেতে হবে। আমরা পিলেকুল না যেয়ে যাব তুমজাং গ্রামে। এই গ্রাম থেকেও আমাদের কাঙ্ক্ষিত চূড়ায় যাওয়ার পথ আছে।

এখন কথা হচ্ছে, গ্রামে গেলেই তো হবে না। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বেম দাদা তার পরিচিত একজনকে ফোন দিলেন। নাম কিমবয় দিদি। মোস্তাক দিদির সাথে কথা বলে নিশ্চিত করল আমরা যাচ্ছি।

দিদি বললেন, ‘কোই বাত নেহি, আ যাও।’ গুপ্তরাজ দাদা আর বেম দাদা বারবার বলে দিলেন, ‘রাস্তা একটাই। আপ বাস যাতে রাহো। সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাবা।’

আরো বললেন, পাহাড়টা উঠে একটা চওড়া রাস্তা পাবো। সেখান থেকে হাতের ডানে যাওয়া লাগবে। বলছিল হাতের ডান, দেখাচ্ছিল বাঁ হাত দিয়ে। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হলাম।

এবার বর্ডারে যেহেতু কিছু পাইনি আর স্টেশনের কাছে ছিলাম যা কিনা শহর থেকে একটু দূরে, তাই ইন্ডিয়ান সিমটাও আর কেনা হয়নি। তো আমরা হারিয়ে গেলেও কাউকে ফোন দেয়ার উপায় ছিল না। যিনি আমাদের পাঠাচ্ছেন আর যার কাছে আমরা যাচ্ছি, দু’পক্ষকেই উৎকণ্ঠায় রেখে পুরোই অদৃষ্টে ভরসা করে অন্যরকম এক উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে হাঁটা ধরলাম তিনজন। প্রথমে জঙ্গলের রাস্তা, গ্রামের মানুষ চলাচল করে মাঝেমধ্যে বোঝা যায়। তবে গাছ, ডালপালায় মাঝেমধ্যেই আটকে যাচ্ছিলাম। এই রাস্তা শেষ হতেই চমৎকার সেই পায়ে হাঁটা পথ শুরু হলো যার ডান দিকে যেতে হবে। দু’পাশে বিশাল বিশাল পাইন গাছ। দূরে উঁকি দেয়া পাহাড়। তখন যদিও মন ভরে প্রকৃতি দেখতে পারছিলাম না। দুশ্চিন্তা ছিল, জানি না আদৌ ঠিকমতো পৌঁছাতে পারব কিনা।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর একটা সাইনবোর্ড পেলাম। ওয়ে টু তুমজাং, সাথে একটা ষাঁড়ের মাথা আঁকা তোরণ। পাশেই একটা তীরচিহ্ন দিয়ে রাস্তা দেখানো। ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে মাউন্ট সেইকলের রাস্তা। একটা দোকানঘরের মতো ছিল পাশে, তবে বন্ধ ছিল। তোরণ দেখে মনে সাহস পেলাম। ঠিক পথেই যাচ্ছি তাহলে। কারণ দাদারা বলেছিল কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই সেইকলের রাস্তা পাব। তবে যেহেতু আজকে সময় নেই, তাই পাহাড়ে না উঠে গ্রামের পথ ধরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল আমাদের। 

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। এবার পেলাম একটা পানির পাইপ। বান্দরবানের অভিজ্ঞতা বলে, এরকম পানির পাইপলাইন কোনো এক গ্রামে গিয়ে শেষ হবে। এদিকে পানির পাইপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই দেখি পাইপ হুট করে বামের ঝিরিতে নেমে গেছে। ওদিকে না গিয়ে আমরা ডানের রাস্তাটাই ধরলাম আবার। জানিনা ঠিক আছে কিনা। কোনো জনমানুষের চিহ্নও নেই। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি রাত জঙ্গলেই কাটানোর। ভাবছি সাথে শুকনো খাবার কি আছে, ঠান্ডা লাগলে পঞ্চো পরে ফেলতে পারব। বেশ এক রাত পার হয়ে যাবে সমস্যা নেই।


মোস্তাক আমাদের পেছনে ফেলে দ্রুত এগোতে থাকে। যেভাবেই হোক তুমজাং গ্রাম না পেলে অন্য কিছু বের করতে হবে। আলো থাকতেই পৌঁছানোর ইচ্ছা আমাদের।

পাহাড়ে ট্রেইলে রাত নেমে আসা মানে ভয়ানক কিছু। তার ওপর আমরা জানিও না আসলে পথ আর কতদূর! এখান থেকেও অনেকটা পথ সামনে হেঁটে গেলাম। সন্ধ্যাও নেমে আসছে প্রায়। ভয়, হতাশা, ক্লান্তি সবই একে একে গ্রাস করতে থাকে।

হঠাৎই দূর থেকে কানে এসে লাগে মোরগের ডাক। কি যে আরাম লাগল এই ডাক শুনে, বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের হাঁটার গতি বেড়ে গেল। কিছুদূর যেতেই বেশ কিছু ঘর চোখে পড়ল। ঘরগুলোর দিকে যাচ্ছিলাম আর এলাকার কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করছিল। কুকুরের ডাকেই কিনা জানি না, একজন বুড়ো লোক আমাদের দিকে এগোলেন। গায়ে ক্যামোফ্লাজ শার্ট-প্যান্ট, কোমরের বেল্টে দা গুঁজে রাখা। মোস্তাক বলেছিল, এই গ্রামের মানুষ হচ্ছে কুকি নৃগোষ্ঠী। অস্পষ্ট হিন্দিতে জানতে চাইলেন, কোথায় যাব? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মোস্তাক, এটা কোন গ্রাম? 
আমরা ধরেই নিয়েছিলাম অন্য কোনো গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি। উনি বললেন, তুমজাং। বললাম, আমরা জোসেফ দাদার বাড়ি খুঁজছি। হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। পরে জেনেছিলাম, উনি হচ্ছেন জোসেফদার বাবা। তার দেখানো পথে এগিয়ে ছোট্ট সুন্দর একটা কাঠের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। বাইরে বারান্দায় কাঠের বেঞ্চি। সিঁড়িতে, বাড়ির বাইরে হরেকরকম ফুলের গাছ। ভীষণ মায়া মায়া একটা বাড়ি। ভেতর থেকে ছোট শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে। 
জোসেফদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গ্রামটার একটা ভালো ভিউ পাওয়া যায়। এই গ্রামে একটা চমৎকার গির্জা আছে। গির্জার পেছনে পাহাড়ের কোলে তখন সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে। ওখানে দাঁড়িয়ে প্রায় অস্তমিত সূর্যের কমলা আলোর দিকে তাকিয়ে তখন অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব হচ্ছিল।

আমাদের কণ্ঠস্বর শুনে ভেতর থেকে কিমবয় দিদি বের হলেন। পিঠে বাঁধা ফুটফুটে এক মেয়ে শিশু। জোসেফ দাদা কাজে গিয়েছিলেন। দিদি আমাদের ভেতরে নিয়ে বসালেন। দাদার এমনিতে এখানে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমরা তিনজন দেখে আমাদের ঘরেই থাকার কথা বলে দিলেন দিদি।

আমরা ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম কম্বলের নিচে। বেশ ঠান্ডা বাইরে। বাড়ির আশপাশে এত গাছ যে বাতাসের শব্দে মনে হচ্ছিল ঝড় হচ্ছে। জোসেফ দাদা ফিরলে পরে আমরা চা খেতে উঠলাম। তখন অনেক গল্প হলো এই মানুষ দু’জনের সাথে।

খুব সাধারণ, সরল আর হাসিখুশি তারা। তিন মেয়ের মা-বাবা। বড় দু’জনের বয়স ১০ আর ৮। তারা থাকে হাফলং শহরে, পড়াশোনা করে ডন বস্কো স্কুলে।

দিদি বললেন, গ্রামে মানুষ দেখছো না তো। কিন্তু আমরা অনেক মানুষ। বেশিভাগই পড়ালেখার জন্য গ্রামের বাইরে। ছোট মেয়ে অলিভিয়ার বয়স নয় মাস। মা-বাবা আদর করে ডাকে পুইপুই।

রাতের খাবারে ভাত, আলুভাজা, ডাল আর ডিম সিদ্ধ ছিল। আলুভাজাটা এত মজা ছিল! কোনো মসলা ছাড়া শুধু লবণ আর তেল দিয়ে আলুর নিজস্ব যে স্বাদটা আছে, সেটাই ভালো লাগছিল।

খাওয়ার পর কিমবয় দিদি আমাদের গান শোনালেন। চমৎকার তার গানের গলা! পুরো পরিবেশটা এমন ছিল যে আমার মনে হচ্ছিল আমি কোনো রূপকথার গল্পে আছি।

দাদা জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মাউন্ট সেইকল যাব কিনা। মোস্তাক জানায়, একদম সর্বোচ্চ চূড়ায় যাব। এত দূর থেকে শুধু সেইকল দেখতে আসিনি।

দাদা বললেন, ওখানে তো যাওয়া কঠিন হবে। অনেকদিন কেউ যায় না। জঙ্গল কেটে রাস্তা বানানো লাগে। গাইডও পাওয়া যাবে না হয়তো। আচ্ছা আমি দেখি।

দুই-এক জায়গায় কথা বলেও কাউকে পাওয়া গেল না। তখন আমাদের অনুরোধে দাদা নিজেই রাজি হলেন আমাদের নিয়ে যেতে। আমরা তো বান্দরবানে সারাদিন না খেয়ে হেঁটে অভ্যস্ত। এদিকে উনি আমাদের সকালে ভরপেট না খাইয়ে কিছুতেই বড় পাহাড়ে নিয়ে যাবেন না। শেষে বুঝিয়ে বললাম যে বেশি খেয়ে আমরা হাঁটতে পারব না। সকালে ম্যাগি খেয়ে বের হয়ে আগে বড় পাহাড়ে যাই, তারপর ফিরে ভালো করে খেয়ে নেব।

দাদা রাজি হলেন। আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেলাম।
লেখা : তামান্না আজমী

মনে করি আসাম যাবো (পর্ব ১)