মনে করি আসাম যাবো (পর্ব ১)

abc

জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে না? আমরা বলি, উপরওয়ালা মিলিয়ে দিয়েছে। আমাদের এবারের ট্যুরটা ছিল ঠিক এরকম। পাজল সলভ করার মতো খাপে খাপে সব মিলিয়ে দিয়েছিলেন বিধাতা।

সেই অক্টোবরে সান্দাকফু ঘুরে আসার পর আর বাসা থেকে বের হইনি। একটা টার্গেট ছিল। কিন্তু তেহজীবের (মেয়ে) পরীক্ষার জন্য সেটা বাদ দিতে হলো। এরপর আবার রমজান, আর বের হওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। আরো অনেক কিছু মিলে বছরের প্রথম ট্যুর হিসেবে ঠিক হলো এবার আমরা আসাম যাব। একটা ছোটখাটো ট্রেক করব। ইউটিউব, গুগল ঘাঁটাঘাঁটি করে যা তথ্য পাওয়া গেল, তার ওপরেই সব প্ল্যান করল মোস্তাক (স্বামী)।

২৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টার ট্রেনে উঠলাম আখাউড়ার উদ্দেশে। আখাউড়ার ট্রেন বেশ ভালো, আরামদায়ক জার্নি ছিল। সাড়ে ১০টার ভেতর পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। ট্রেন থেকে নেমে অটোরিকশা নিয়ে আখাউড়া বর্ডার চলে গেলাম। ওদিকে খাবার হোটেল নেই ভালো। সকালের নাস্তা পাওয়া গেল না কোথাও। আমরা বাসা থেকে হালকা খেয়ে বের হই। মোস্তাককে বললাম, ‘বর্ডারে কাজ শেষ করি, ওপাড়ে গিয়ে খাব।’

মূলত ত্রিপুরা, আসাম এসব স্টেটে ভ্রমণের জন্য আখাউড়া-আগরতলা বর্ডার ব্যবহার করা হয়। এই বর্ডার হয়ে মানুষজন কমই যায়। আমাদেরও এই বর্ডার দিয়ে প্রথম যাওয়া। ভীড় ছিল না বললেই চলে। তবে ভীড় না থাকার কারণে খুব সময় নিয়ে চেকিং হয়। মানিব্যাগ, ট্রেকিং পোল, মোবাইল ব্যাগ সবই চেক হয়, যা অন্য বর্ডারে খুব একটা হয় না। তবুও সব ফর্মালিটির পর আমরা যখন বর্ডার পার হই, ঘড়িতে তখন মাত্র ১২ বাজে। এতটাই কাছে আগরতলা!

এই পাড়ে এসে দেখি একেবারেই ধু ধু মরুভূমি। দোকানপাট নেই কোনো। চওড়া রাস্তাঘাট, আশপাশে প্রচুর কন্সট্রাকশন চলছে। রোদের উত্তাপে তাকিয়ে থাকা দায়। খাবার হোটেলের দেখাই পাওয়া গেল না। কারেন্সি চেঞ্জের দোকান আছে কিছু। এই বর্ডারে বেনাপোল থেকে রেট একটু কম পাওয়া যায় সবসময়। এদিকে সবার মুখের ভাষা আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো। এমনকি, দুয়েকজন তো নোয়াখালীর মতো ‘বুইজ্জেননি’-ও বলে!

মানে বোঝার উপায় নেই আমি অন্য দেশে আছি। যাই হোক, সব কাজ শেষে অটো ধরলাম শহরের উদ্দেশে।

আগরতলায় থাকা-খাওয়ার জন্য খুব জমজমাট জায়গা বটতলা। তবে আমাদের পরদিন ভোর সাড়ে ৫টার ট্রেন শুনে অটোচালক দাদা স্টেশন থেকে ঠিক পাঁচ মিনিটের দূরত্বে হোটেল পূর্ণিমায় নামিয়ে দিলেন। রুমও পছন্দ হলো। দ্রুত রুমে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

বের হওয়ার সময় রিসেপশনের দাদা খাবারের জন্য হোটেল সংস্কারের নাম বলে দিয়েছিলেন। হোটেলটা আগরতলা স্টেশনের উল্টা দিকের ঢালু একটা রাস্তায়। আগরতলা স্টেশনটা এত সুন্দর! কী রাজকীয় তার গেট! একসময় রাজবাড়ি ছিল হয়তো।

হোটেলের খোঁজে উল্টা দিকের ঢালে নেমে পড়লাম। পেয়ে গেলাম সংস্কার। ছিমছাম ছোট একটা রেস্টুরেন্ট। তিনজন তিনটা থালি অর্ডার করলাম। পেটে তখন ইঁদুর দৌড়াচ্ছে।

গরম গরম খাবার এলো। ইন্ডিয়া গেলে থালিটাই আমার সবচেয়ে সেরা মনে হয়। থালিতে বেগুন ভাজা, চাটনি, সবজি, ডিম, টমেটোর টক, ডাল আর পাপড়ও ছিল। সবকিছু খেয়ে পাপড় আর খেতে পারিনি। শেষে ডেজার্ট হিসেবে ছিল আমার পছন্দের শনপাপড়ি। তেহজীব দেখি কিছুটা শনপাপড়ি নিয়ে পানিতে ফেলে খাচ্ছে। আমি বললাম, কী দরকার আছে এটা করার? উত্তর দিল, Everything is an experiment maa, including life!

খাওয়া শেষে ওখানে কিছু ছবি তুলে আমরা আবার হোটেলে ফিরে গেলাম। একটু রেস্ট নিয়ে রোদটা পড়লে বের হবো এমনই প্ল্যান। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। মোস্তাক যখন ডাকলো, তখন ঘড়িতে ৬টা। 

আগরতলায় বইমেলা চলছিল। মেলাতেই ঘুরতে যাব আমরা। দুপুরে খুব বেশি খেয়ে ফেলার পর ভাবলাম আস্তে-ধীরে হেঁটেই যাই। অটোর দাদা দেখিয়ে দিয়েছিলেন বইমেলার লোকেশন। সে অনুযায়ীই হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একসময়।

বেশ বড়সড় জায়গা নিয়ে গোছানো একটা মেলা। ট্রাইবাল স্টলগুলো এক ব্লকে, কলকাতার স্টলগুলো আলাদা ব্লকে। নানারকম ব্লকে ভাগ করা এবং নাম লেখা। বই দেখলাম, চা-পাকোড়া খেলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল বেশ বড় করে দেয়া বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে। বুকটা গর্বে ভরে উঠল।

ভীনদেশে নিজের দেশের নাম দেখতে পাওয়া সবসময়ই আনন্দের। মেলায় সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। বিভিন্ন গান, একটা বিশেষ উপজাতিদের ধর্মীয় নাচ সবই খুব ভালো ছিল। বের হয়ে বাইরে অনেক স্ট্রিটফুড দেখলাম। তেজু চিকেন ফ্রাই খেল আর আমরা এগরোল, পিঠা খেয়ে নিলাম।

ডিনার শেষ, আর কিছু না খেলেও চলবে। হোটেলে ফিরে বাসায় ফোন দিয়ে কথা বলে নিলাম। এরপর ব্যাগ মোটামুটি গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভোরের ট্রেন যেহেতু, বেশি রাত জাগা ঠিক হবে না।

লেখা : তামান্না আজমী