মনে করি আসাম যাবো (পর্ব ৪)
পরদিন সকালে উঠে সব গুছিয়ে নিলাম। সকালের খাবারে অন্যরকম একটা পদ ছিল। কলাগাছের ভেতরের কচি অংশ, যার নাম ভাদাইল (আমাদের আঞ্চলিক ভাষায়), খেতে বাঁশকোড়লের মতো। ডাল দিয়ে রান্না করেছিল। সাথে সিদ্ধ ডিম। এটাও বেশ ভালো ছিল খেতে। খেয়ে আমরা বের হবো। দাদা ওদের ঐতিহ্যবাহী উত্তরীয় দিয়ে মোস্তাককে বিদায় সংবর্ধনা জানালেন।
আইলম দৌড়ে এসে আমাকে দেখতে নিয়ে পড়ে গেল। খুব জোরে ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠল। দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে একটু পিঠ চাপড়ে দিতেই শান্ত হয়ে গেল। মা আর সন্তানের সম্পর্কটা বোধ করি সার্বজনীন। আমি ওর মা ছিলাম না, তবে সব মায়ের আদর মনে হয় একইরকম। ঠিকই কাঁধে মাথা ফেলে চুপ করে ছিল বাচ্চাটা। আমার খুব মায়া লাগছিল ওদের ছেড়ে আসতে।
একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। যেখানে জানতামই না কি হবে, সেখানে সবকিছু দেখে যাচ্ছি। এত অনিশ্চিতভাবে নিশ্চিত ট্যুর এই প্রথম! ভালো লাগছিল।
মোস্তাকের ফোনে হালকা করে গান বাজছে, আমরা হাঁটছি, তেহজীব আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছে। আজকে আমাদের অঢেল সময়। হেলেদুলে মেঠো পথটা পার হয়ে সেই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে নামতে হবে। এইবার হলো কি, ঠিক কোন জায়গাটা দিয়ে আমরা উঠে এসেছিলাম এটা আর মনে করতে পারছি না। আমার শুধু মনে পড়ছিল, বড় একটা পাথর ছিল, যার পাশ দিয়েই নিচে নামা লাগবে।
এখন যেদিকে তাকাই দেখি বড় বড় পাথর। ১০ মিনিট সময় লাগল খুঁজে বের করতে সেই রাস্তা। অবশেষে পেয়ে গেলাম। এবং আমরা ঠিক পথেই ছিলাম। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর গাড়ির শব্দ পেলাম। রাস্তাও দেখতে পাচ্ছিলাম। ঠিক রাস্তায় পা ফেলার আগমুহূর্তে শুকনো মাটিতে এই ট্রেকের একমাত্র আছাড়টা আমি খেয়ে ফেললাম। যাই হোক, রাস্তায় নেমে ডানদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এদিক দিয়ে এগোলেই পিলেকুল গ্রাম।
জোসেফ দাদাকে বলেছিলাম, পিলেকুল গ্রামটা ঘুরে দেখে যাব।
দাদা পিলেকুলেরই এক অটোওয়ালার সাথে কথা বলেছিলেন আমাদের মাহুর পৌঁছে দেয়ার জন্য। আর বেম দাদার সাথেও দেখা করার ইচ্ছা। রাস্তার কাজ চলছে দেখা যাচ্ছে। ল্যান্ডস্লাইড বন্ধ করতে যা করা দরকার সবই করছে ওরা। ১৫ মিনিট হেঁটে পিলেকুল পৌঁছে গেলাম। অনেক বড় গ্রাম এই পিলেকুল। পিলেকুল অর্থ পুরানো লেকুল। দেড় শ’ বছরেরও পুরোনো এই গ্রামের মানুষগুলোও ভালো। বড় একটা খেলার মাঠ আছে। মাউন্ট সেইকল থেকে নিচে তাকালে এই গ্রাম দেখা যায়।
আমরা গ্রাম ঘুরে দেখতে লাগলাম। দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম বেম দাদার ব্যাপারে। হঠাৎই একটা দোকানের সামনে তাকে পাওয়া গেল। দোকানের ভেতর গিয়ে বসলাম। দেখি এক দিদি পরোটা ভাজছেন। সাথে সাথে পরোটা, ডিম, ডাল আমাদের জন্য আর বেম দাদার জন্য চিকেন অর্ডার করে দিলাম। এর মাঝে এক বয়স্ক লোক এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা তুমজাং থেকে এসেছি কিনা। জানা গেল তিনি সেই অটোওয়ালা যাকে জোসেফদা ঠিক করেছিলেন।
বলেছিলাম না সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছিল। আমাদের কিছুই করতে হচ্ছিল না। সব এমনিই হয়ে যাচ্ছিল।
ভরপেট নাস্তার পর আমার পরম সৌভাগ্য। দিদি বললেন, এখানে দুধ চা পাওয়া যায়। পরপর দুই কাপ দুধ চা খেয়ে নিলাম। অনেক দিন পর আমিষ খেয়ে শরীর আর মন দুটোই চাঙা হয়ে গেল! বেম দাদা আর দোকানের দিদির থেকে বিদায় নিয়ে অটোতে উঠে বসলাম। অটোর দাদা খুব সাবধানে চালিয়ে আমাদের মাহুর নামিয়ে দিলেন। মাহুর থেকে গাড়ি যায় হাফলং পর্যন্ত। জনপ্রতি ১২০ রুপি করে। আমরা এরকম একটা গাড়ি করেই হাফলং পর্যন্ত গেলাম।
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নেমে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে তিনটা হোটেলের নাম পাওয়া গেল। এলিট, নোথাও আর নোশ্রিং। নোথাওতে রুম দেখে এরপর হোটেল এলিট এবং তারপর নোশ্রিংয়ে খোঁজ নিয়ে বের হতেই চোখে পড়ল তেহজীবের কাঁধের ব্যাগটা নেই। মোস্তাক প্রায় দৌড়ে আবার নোশ্রিং গিয়ে দেখল, ব্যাগ নেই। এরপর ঝড়ের গতিতে হেঁটে এলিটে চলে গেল। আমরাও প্রায় দৌঁড়াচ্ছিলাম। তখন দেখি ও ব্যাগ হাতে আসছে আমাদের দিকে। এই ব্যাগে আমাদের পাসপোর্ট ছিল। হারালে যে কি হতো!
যাইহোক, তিন জায়গায় রুম দেখে এরপর নোথাওতেই থাকব ঠিক হলো। খুবই সুন্দর এই রিসোর্টটা। নোথাও অর্থ গেস্টহাউজ। আমরা রুমে উঠে ফ্রেশ হয়ে সাথে থাকা কেক, বিস্কুট আর মাহুর থেকে কেনা কমলা খেয়ে নিলাম। এরপর হাফলং শহর ঘুরতে বের হলাম। অটো নিয়ে শহরের লেকের ধারে চলে গেলাম। লেক ঘিরে একটা ব্রিজ আছে। সেই ব্রিজে হেঁটে লেকের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত যাওয়া যায়।
অটো ড্রাইভার বলে দিয়েছিল যে সন্ধ্যার আগে ফিরে যেতে। সন্ধ্যার আগেই লেক থেকে বের হয়ে এবার আর অটো নিলাম না। শহরের রাস্তাঘাট অনেক চওড়া। হেঁটে দেখলাম, ছবি নিলাম। ডন বস্কো স্কুলের বিশাল ক্যাম্পাস দেখলাম। তারপর হাফলং বাজারে চলে আসলাম। পানিপুরি খেলাম, একটা মিষ্টির দোকানে বসে দই-মিষ্টি খেলাম।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ছবি তুলে নিলেন দোকানের মালিক। তারপর ফিরলাম রিসোর্টে। আগেই রাতের খাবারের জন্য থালি অর্ডার দেয়া ছিল। ১০টা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে নিলাম।
লেখা : তামান্না আজমী