মাউন্ট এভারেস্ট : চূড়ায় পৌঁছাতে যেভাবে প্রস্তুতি নেবেন
পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা যে কোনো পর্বতারোহীর কাছেই স্বপ্ন এবং প্রতি বছরই এভারেস্ট অভিমুখী পর্বতারোহীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু যথাযথ প্রস্তুতির অভাবসহ নানা কারণে অনেকেই দুর্ঘটনায় পড়েছেন, এমনকি মারাও গেছেন অনেক পর্বতারোহী।
গত দুই দশকের হিসেবে দেখা যায়, হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করতে গিয়ে প্রতি বছর গড়ে ছ'জন আরোহী মারা যায়।
শুধু ২০১৯ সালেই ৮৮৪৮ মিটার উচ্চতার (সম্প্রতি চীন ও নেপাল যৌথভাবে ঘোষণা করেছে যে এই উচ্চতা আরো ৪৮ সেন্টিমিটার বেড়েছে) এভারেস্টে আরোহণ করতে গিয়ে মারা গেছেন ১১ জন। ওই বছরেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে এভারেস্টে ওঠার অনুমতি দিয়েছিল নেপাল সরকার।
অনুমতি পাওয়া ৩৮১ জনের সাথে ছিল গাইডসহ কিছু কর্মকর্তাও।
বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট জয়ী নারী নিশাত মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এভারেস্ট যাত্রা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ব্যাপক প্রস্তুতির বিষয়।
’আমি প্রথমে বাংলাদেশে পাহাড় দিয়েই শুরু করেছিলাম। ট্রেনিং করেছি। ছোটো ছোটো পাহাড়ে গিয়ে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলাম। পরে পাঁচ, ছয় কিংবা সাত হাজার মিটার উচ্চতার দিকে ধীরে ধীরে গিয়ে এভারেস্টের জন্য তৈরি হয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমত মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। কেন আমি পাহাড়ে যাব এ প্রশ্নের উত্তর জানা থাকা চাই। এরপর শারীরিক প্রস্তুতি। কিছু স্ট্রাকচারড ট্রেনিং আছে ভারতে করা যায়। এরপর ধীরে ধীরে একটি পর একটি বেশি উচ্চতার পাহাড়ে যাওয়াই উত্তম।’
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো বান্দরবানের একটি পাহাড়ে উঠেছিলেন নিশাত মজুমদার, আর পরে এভারেস্ট জয় করেন ২০১২ সালে।
তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম আমি। প্রথমে ট্র্যাকিং, তারপর হাইকিং, একাডেমিক ট্রেনিং, স্ট্রাকচারড ট্রেনিং এবং এরপর বড় বড় পাহাড়গুলোর দিকে ক্রমান্বয়ে যাত্রা করার মাধ্যমেই আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি।’
মূলত ২০১০ সালে নেপালে নতুন একটি পর্বতে ওঠে নিশাত মজুমদার সহ বাংলাদেশীদের একটি দল এবং পরে ছয় হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার ওই পর্বতের নামকরণ করা হয় নেপাল-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পিক।
‘শেরপারা (পর্বতে আরোহণের গাইড) বলছিলেন, এটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং এভারেস্টে ওঠার চেয়েও কঠিন। ওটা করার পরই ভাবলাম এটি যখন পারলাম তাহলে এভারেস্ট নয় কেন। নতুনদের এভাবে ধারাবাহিক চিন্তা করাই ভালো হবে বলে মনে করি।’
বাংলাদেশীদের মধ্যে প্রথম এভারেস্টে উঠেছিলেন মুসা ইব্রাহিম। আবার দু’বার এভারেস্টে আরোহণ করেছেন এম এ মুহিত। নারীদের মধ্যে নিশাত মজুমদার ছাড়াও এভারেস্টে পৌঁছেছিলেন ওয়াসফিয়া নাজরীন।
আবার এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে মারা গেছেন সজল খালেদ।
আর সর্বশেষ এভারেস্ট জয়ী বাংলাদেশী বাবর আলী, পৌঁছেছিলেন ২০২৪ সালের মে মাসে। একই সাথে প্রথমবারের মতো লোৎসে পর্বতে উড়ান লাল-সবুজের পতাকা।
পর্বতারোহণবিষয়ক প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহী। গ্রাজুয়েশন করেছেন নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং থেকে।
তিনি বিবিসিকে বলছেন, ঠিক মতো সব কিছু করতে হলে অন্তত ৩/৪ বছরের প্লানিং দরকার। কারণ এভারেস্ট কোনো সহজ গেম নয়।
তিনি বলেন, ‘ওখানে বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতা আছে তাই এটি দুরূহ। বাংলাদেশে এডভেঞ্চার কোর্স করছে অনেকে এখন। এরপর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশিক্ষণ নেয়া যেতে পারে। প্রতি বছর অন্তত দুবার অতি উচ্চতার পাহাড়ে গিয়ে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে। এরপর ৬/৭ হাজার মিটার পর্যায়ক্রমে যেতে পারলেই মনে হবে যে এভারেস্টের জন্য প্রস্তুত আমি।’
তিনি বলেন ২/১ টি পর্বতে গিয়ে এভারেস্টের চিন্তা করা লাইফ রিস্ক কারণ আট হাজার মিটারের ওপর উচ্চতায় শরীরের কোষ তৈরি হয়না। ফলে জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি প্রতি পদে পদে।
’তাই পর্বতের আদ্যোপান্ত জানতে হবে। সেলফি বা ফেসবুকে দেখানোর জন্য করার বিষয় এটি নয়।’
যেসব প্রশিক্ষণ জরুরি এবং কোথায় শিখবেন
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহী ও নিশাত মজুমদার- দুজনেই বলছেন কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরি বিশেষ করে আট হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার পর্বতের জন্য। এগুলো হলো:
১. মানসিক প্রস্তুতি
২. শারীরিক প্রস্তুতি
৩. আর্থিক প্রস্তুতি
৪. পর্বতের জন্য টেকনিক্যাল জ্ঞান
মহিউদ্দিন মাহী বলছেন, আট হাজারের মিটারের কাছে গিয়ে শরীর কাজ করে না, তখন মানসিক শক্তিই এগিয়ে নেবে এবং সেই অবস্থায় কোনো সমস্যা হলে দরকার হবে টেকনিক্যাল জ্ঞান।
’যার অভিজ্ঞতা যত বেশি, তার মানসিক শক্তি বেশি থাকবে। তিনিই সফল ভাবে সামিট করে ঠিকমতো ফিরে আসতে পারবেন।’
তিনি বলেন, দেশে ছোটো ছোটো পাহাড়ে নিয়মিত ট্রেকিং করে শুরু করে পরে ভারতের আনুষ্ঠানিক ট্রেনিং নেয়া যায় যেখানে পর্বতে নিয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
’পর্বতের বরফে কৃত্রিম ঝুঁকির পরিবেশ তৈরি করে তা থেকে কিভাবে বেঁচে আসবেন সেগুলো শেখানো হয় ভারতীয় ইন্সটিটিউটগুলোতে। পর্বতারোহণের টেকনিক, ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করে ওপরে ওঠার মতো টেকনিক্যাল বিষয়গুলো শেখা জরুরি।’
খরচ হবে কেমন : বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ সুযোগ কতটা আছে
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহী ও নিশাত মজুমদার দুজনেই বলছেন, এটি দীর্ঘমেয়াদী ব্যয়বহুল খরচের বিষয়।
২০২০ সালে নিশাত মজুমদার বিবিসিকে জানান, শধু এভারেস্টে ওঠার জন্যই ব্যয় করতে হবে কমপক্ষে পঞ্চাশ লাখ টাকা।
এর মধ্যে নেপালে সরকারি ফি এগার হাজার ডলার। এর বাইরে এভারেস্ট যাওয়ার ব্যবস্থাপনার এজেন্সি খরচ, বাংলাদেশ থেকে যাতায়াত খরচ এবং পর্বতারোহণের ইকুইপমেন্ট খরচ বহন করতে হবে পর্বতারোহীকেই।
এর আগে ভারতে ট্রেনিং করতে হলে একমাসের জন্য প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হবে আটশ ডলার। সাথে যাতায়াত খরচ সহ আনুষঙ্গিক ব্যয় আছে।
নিশাত মজুমদার বলছেন এভারেস্টে ওঠার আগে কয়েক বছর যে ধারাবাহিকভাবে ৫/৬/৭ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বত শৃঙ্গে উঠবেন তার প্রতিটির জন্যই ব্যয় হবে ৮-১০ লাখ বা তারও বেশি পরিমাণ টাকা। বিশেষ করে গাইড বা শেরপাদের জন্যই বিপুল অর্থ দিতে হয়।
* (এই খরচ বর্তমানে বেড়েছে আরো)
মহিউদ্দিন মাহী বলছেন, সব মিলিয়ে এভারেস্ট অভিযান পর্যন্ত ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকারও বেশি দরকার হতে পারে।
’এভারেস্ট এর আগে আরো ৫/৬ টা অভিযানের অর্থের যোগান দিতে হবে, যার প্রতিটা অভিযান ক্ষেত্র বিশেষে এক লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৫-১০ লাখ টাকাও হতে পারে।’
বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এডভেঞ্চার ও পর্বতারোহণের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ শুরু করেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যার একটির নাম ‘রোপ ফোর’।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মারুফা হক বলছেন, তারা দেশেই ক্যাম্পিং করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন পার্বত্য এলাকাগুলোতে যেখানে প্রাকটিকাল কিছু ট্রেনিং দেয়া হয়।
’আমরা ২০১৮ সালে আগ্রহী ১৬০ জনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে তিনজনকে নেপালে পাঠিয়েছিলাম সাড়ে ৫ হাজার মিটার উচ্চতার পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের জন্য। আশা করি সামনে তারা ভালো করবেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।’