বান্দরবানের বাকলাই জলপ্রপাত যাওয়ার উপায় ও খরচ
বিপজ্জনক ঝিরিপথ দিয়ে কারুকার্যমন্ডিত দুর্গম পাহাড়ের অন্দরমহলে গুপ্ত এক অমূল্য ঐশ্বর্য হলো পাহাড়ি ঝর্ণা। হাজার বছরের প্রাকৃতিক ঘাত-অপঘাতের চিহ্নগুলো আড়াল করে অভিকর্ষের কাছে নিজেকে সপে দেয় প্রস্রবণগুলো। মুক্ত বিসর্জনের এই শব্দে সেই অপঘাতে সৃষ্ট খাদগুলোতে শোনা যায় মহাকালের ফিসফিসানি। যেন প্রকাণ্ড সফেদ পর্দার অন্তরালে লুকানো পাহাড়ের কান্না। কখনও বা স্বচ্ছ স্নিগ্ধ ধারায় অনাবৃত হয়ে পড়ে অমসৃণ কলেবর। ঠিক এমনি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সন্ধান দিতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম সুউচ্চ প্রাকৃতিক ঝর্ণা বাকলাই ভ্রমণে। অসাধারণ উচ্চতার এই জলপ্রপাতটি নিয়েই আজকের ভ্রমণ কড়চা। চলুন, কখন ও কীভাবে খুব কাছ থেকে এই বুনো ঝর্ণার দর্শন পাবেন- তা জেনে নেওয়া যাক।
বাকলাই ঝর্ণার ভৌগলিক অবস্থান ও বিশেষত্ব
বান্দরবানের থানচি উপজেলাটি বাংলাদেশের পাহাড়প্রেমীদের কাছে সর্বাধিক পরিচিত। এই অঞ্চলেরই নাইটিং মৌজার বাকলাই গ্রামের মধ্যমণি প্রায় ৩৮০ ফুট উঁচু বাকলাই জলপ্রপাত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পাহাড় কেওক্রাডং ও তাজিংডং-এর মাঝেই এই গ্রামটির অবস্থান। রুমা থেকে ১১০ কিলোমিটার এবং থানচি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূর থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে এই ঝর্ণা।
স্থানীয়দের অনেকে একে বাক্তালাই ঝর্ণা নামেও অভিহিত করেন। মাত্রাতিরিক্ত ভয়াবহ পাহাড়ি রাস্তা থাকায় এবং যথেষ্ট উদ্যোগের অভাবে খুব কম পর্যটকই এই জলপ্রপাতের একদম পাদদেশ পর্যন্ত যেতে পারেন।
এই বাকলাই আর লিলুক বা লাংলোক নামে থানচিরই আরেকটি ঝর্ণার সঠিক উচ্চতা নিয়ে বেশ মতোপার্থক্য রয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ ঝর্ণার খেতাব নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকলেও সৌন্দর্য্যের দিক থেকে বাকলাই ঝর্ণা অনেকটা এগিয়ে।
ঢাকা থেকে বান্দরবানের বাকলাই ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার উপায়
বাকলাই জলপ্রপাত দেখার জন্য শুধুমাত্র বাসে করে ঢাকা থেকে সরাসরি বান্দরবান পৌঁছা যায়। গাবতলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান, যাত্রাবাড়ি, মহাখালী বা ফকিরাপুল থেকে মাথাপিছু ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা ভাড়ায় বিভিন্ন বাস বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
রেলপথে যেতে হলে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে তারপর আবার বাসে করে বান্দরবান পৌঁছতে হয়। কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনগুলো শ্রেণীভেদে জনপ্রতি ২৮৫ থেকে ৭৮৮ টাকা ভাড়া নিয়ে থাকে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিমানে করে গেলে সময় লাগে মাত্র ১ ঘণ্টা, তবে তাতে খরচ হতে পারে জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ১৭৫ টাকা। কিন্তু কমপক্ষে ১ মাস আগে অগ্রীম সিট বুকিং দিলে টিকিট মূল্যে ছাড়ের সুযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রামে পৌঁছে এবার বিআরটিসি কিংবা দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বান্দরবানের বাস ধরতে হবে। এখানে বাসভাড়া বাবদ জনপ্রতি ২২০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
বান্দরবান থেকে বাকলাই ঝর্ণার দর্শন পেতে থানচি বা রুমা দুটির যে কোনোটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
সদর থেকে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দূরত্বে থানচির পথে গেলে ‘চান্দের গাড়ি’ ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যে নামিয়ে দেবে থানচি বাজারে। এখান থেকে গাইড নিয়ে নিতে হবে, যেটি বাকলাইয়ের জন্য খুবই দরকার। কেননা এই জলপ্রপাত এখন পর্যন্ত কোনো পর্যটন স্থান হিসেবে গড়ে উঠেনি। তাছাড়া খুব বেশি দুর্গম হওয়াসহ নানা কারণে আর্মিরাও সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। এই ঝক্কি ঝামেলায় সাহায্য করতে পারে স্থানীয় গাইড।
বাকলাই পাড়া যাবার পথে তুতং পাড়া, বোর্ডিং হেডমেন পাড়া ও কাইতুন পাড়ার মতো কিছু ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। বাকলাই গ্রাম থেকে ঝর্ণা পর্যন্ত আরও ১ ঘণ্টা। এমনকি জলপ্রপাতের ওপরে উঠতে গেলেও প্রায় ১ ঘণ্টার ট্রেকিং করতে হয়।
এই হচ্ছে থানচি দিয়ে যাবার পথ। এবার আসা যাক রুমার রুট প্রসঙ্গে। বান্দরবান সদর থেকে চান্দের গাড়িতে রুমায় যেতে প্রায় ৪ ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগে। এ পথে বগালেক পর্যন্ত গাড়িতে এসে হাটা শুরু করতে হবে। অতঃপর কেওক্রাডং হয়ে তাজিংডং যাবার পথেই মাঝে পড়বে বাকলাই গ্রাম।
সর্বোপরি, এই পুরো যাত্রা স্বাচ্ছন্দ্যে সম্পন্ন করতে হলে ন্যূনতম ৫ থেকে ৭দিন সময় নিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের অন্যতম সুউচ্চ ঝর্ণা বাকলাইয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য
পাহাড়ি রাস্তার রোলার কোস্টারের পথ পেরিয়ে মেঘে ঢাকা বাকলাই গ্রামে পৌঁছানোর পর পেছনের ভয় ও কষ্ট মেশানো পথ পাড়ি দেওয়াকে সার্থক মনে হবে। পাহাড়ের ওপরে এক খণ্ড স্বর্গ যেন নিচের ফেলে আসা বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোর উপর কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। এই স্থানটি ইতোমধ্যে ক্যাম্পিংয়ের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সৌভাগ্যবশত যদি পূর্ণিমার রাত পাওয়া যায়, তাহলে বাকলাই জনগোষ্ঠীদের সঙ্গে কাটানো রাতটি হতে পারে জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। শহুরে রাস্তা থেকে এতটা ওপরে পোকামাকড়ের শব্দমাখা নিরবতা এক অদ্ভূত প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।
এখানে রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প, যার আশেপাশের গ্রাম বা পাড়াগুলোর প্রত্যেকটিতে প্রায় ২০টি পরিবারের বাস।
দুঃসাধ্য ট্রেকিংয়ের গন্তব্য কিন্তু এখানেই শেষ নয়; ঝর্ণা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য পেরতে হবে আরও এক ঘণ্টার হাঁটা পথ।
ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছার পর এর অপরিমেয় উচ্চতা দেখে অভিযাত্রীদের রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার দশা হয়। অত উচ্চতা থেকে নিচের পাথরে পানির তীব্র বেগে আঁছড়ে পড়ার শব্দ মনে সঞ্চার করে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এই প্রাকৃতিক বিষয়ের কাছে নিজেকে এবং জাগতিক জীবনের সমস্যাগুলোকে মনে হয় ক্ষুদ্র।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
বাকলাই ঝর্ণা গন্তব্যে যেতে যাত্রা বিরতি বা রাত্রি যাপনের জন্য আছে থানচি কুটির বা বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কটেজ। থানচি বাজারে সাঙ্গু নদীর পাশে এবং বাকলাই গ্রামে মাচাং ঘর বা জুম ঘরে থাকা যেতে পারে। বান্দরবান সদরের পর ভালো খাবারের রেস্তোরাঁ আছে শুধুমাত্র থানচিতে। এরপর অল্প কিছু মোটামুটি মানের হোটেল পাওয়া যাবে শেরকর পাড়াতে।
বাকলাই ঝর্ণার আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
থানচি রুমার বিশাল সার্কিটটা ছোট-বড় বিভিন্ন ঝর্ণায় পরিপূর্ণ। তন্মধ্যে বাকলাইয়ের পথে রয়েছে জিনসিয়াম ঝর্ণা, জনপ্রিয় জাদিপাই জলপ্রপাত এবং একই জায়গা পাশাপাশি দুই ঝর্ণা বিশিষ্ট তলাবং ঝর্ণা। এছাড়া কেওক্রাডংয়ের পাশাপাশি পাওয়া যাবে ক্যাপিটাল পাহাড় জয়ের হাতছানি।
বাকলাই ঝর্ণা ভ্রমণের সেরা সময়
অধিকাংশ ঝর্ণার মতো এই ঝর্ণাও তার পরিপূর্ণ নান্দনিক রূপ ফিরে পায় বৃষ্টির মৌসুমে। ভারী বর্ষণ বা মুষলধারার বৃষ্টির সময়গুলোতে ঘন সফেদ প্রস্রবণে পেছনে পাহাড়ের খানাখন্দ সব ঢাকা পড়ে যায়। বর্ষার কাছাকাছি গরমের দিনগুলোতে ধীরে ধীরে এই জলপ্রপাত পাতলা হতে থাকে। অতঃপর হেমন্ত শীতের দিকে একদম সরু রেখায় পরিণত হয়।
তবে বর্ষাকালে এই ঝর্ণার পাদদেশ পর্যন্ত যাওয়া বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার। আবিষ্কারের পর থেকে এখনও আগের মতো রেখে দেওয়ায় ঝিরিপথগুলো অত্যন্ত দুর্গম বলা যায় ।
বাকলাই জলপ্রপাত ভ্রমণ নিঃসন্দেহে মুগ্ধতা ও বিস্ময়ের এক দ্বৈত অনুভূতির সঞ্চার করে অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্য্যের সন্ধানীদের। তবে এরকম দুর্গম পথ পরিভ্রমণে যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের জন্য প্রথমেই বাকলাই অভিমুখে রওনা হওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
অবশ্য টুটাংপাড়া, বোর্ডিং হেডম্যানপাড়া ও কাইতানপাড়া পেরনোর সময় ক্ষাণিকটা হলেও প্রস্তুতি পাওয়া যায় সামনের অপ্রতিরোধ্য পথের জন্য।
আর্মি ক্যাম্প থাকায় নিরাপত্তা বেশ ভালো। তবে বিড়ম্বনা হতে পারে স্বাধীনভাবে দুঃসাহসিকতা চর্চা করতে চাইলে । সেজন্য ভ্রমণের সময় জাতীয় পরিচয়পত্রসহ (এনআইডি কার্ড) পেশা সম্পর্কিত পরিচয়পত্রাদি সঙ্গে রাখা জরুরি। সূত্র : ইউএনবি