রাফির মৃত্যু : পাহাড় আর না হোক শোকের জায়গা

abc

বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলার চিম্বুক রেঞ্জেই কির্সতং পাহাড়। আর এই পাহাড়ের কাছের একটা বুনো ঝর্ণার নাম ‘সাইংপ্রা’। এত দিন শুধু পাহাড়প্রেমীদের কাছে পরিচিত থাকলেও সম্প্রতি এক দুর্ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হয় এই ঝর্ণাটা নিয়ে।

রোববার (১৩ আগস্ট) জানা যায়, এই ঝর্ণায় রাফি নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃত্যু সময় এবং কারণ নিয়ে বেশ দ্বিধায় সবাই।

রাফির পুরো নাম মোহাম্মদ আতাহার ইসরাক রাফি, বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নে। তিনি একজন ট্যুর আয়োজক বা অপারেটর। ফেসবুকে ‘বিডি ট্রাভেল লাভার’ নামে একটা গ্রুপ পরিচালনা করতেন। ফেসবুকে ট্যুরের ইভেন্ট মার্কেটিং করেই সফরসঙ্গী জোগার করতেন।

শনিবার (১২ আগস্ট) বিকেলে ঘটনার সূত্রপাত। খেমচং পাড়া থেকে স্থানীয় গাইডসহ ২৪ জনের টিম নিয়ে সাইংপ্রা ঝর্ণা দেখতে যান রাফি। সাথে ছিলেন রাফির স্ত্রী বর্ষা ইসলাম এবং আরেক ট্যুর অপারেটর আবির হোসেন। ঝর্ণাটির আবার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে, তার দ্বিতীয় ধাপে পা স্লিপ করে নিচে পড়ে যান রাফি। মাথাসহ শরীরের আরো কয়েক জায়গায় আঘাত লেগে গুরুতর আহত হন তিনি, শুরু হয় রক্তপাতও। রাফি একদমই আনাড়ি ছিলেন না, এমন দুর্গম পথে রাফির পদচারণা বেশ কয়েক বছর ধরেই। সাইংপ্রা ঝর্ণায়ও যাওয়া হয়েছে তার অনেকবার।

রাফির পড়ে যাওয়া সময় তার কাছাকাছি বর্ষাসহ আরো ছয়জন ছিলেন। একটু সামনেই ছিলেন আবির। তিনি পড়ে যাওয়ার পরে আবিরসহ কয়েকজন রাফির রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করেন। একটু দূরে থাকায় টিমের বাকিরা এ ঘটনা তখনো জানত না। তারা ঝর্ণা দেখা শেষ করে খেমচং পাড়ায় ফিরছিলেন। আবির ও বর্ষারা কয়েকজন মিলে রাফিকে ঝিরি পথে নিয়ে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তারা প্রায় ঝিরিপথের শেষ দিকে, ততক্ষণে রাফির অবস্থা আরো গুরুতর।

জায়গাটা এতটা গহীন ছিল যে মোবাইল নেটওয়ার্কও ছিল না কাছাকাছি দুরত্বে। একটু এদিক সেদিক ঘুরে নেটওয়ার্ক না পেয়ে টিমের ছয়জনকে রাফির কাছে রেখে পাড়ায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন বর্ষা। বর্ষা ও আবিরের সিদ্ধান্ত, পাড়ায় গিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় রাফিকে উদ্ধার করা এবং মোবাইল ফোনে পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করা।

বর্ষা ও আবির খেমচং পাড়ায় পৌঁছান রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায়। ফেরার পথে দুই পাহাড়ি ব্যক্তির সাথে দেখা হওয়ায় তাদের রাফির দুর্ঘটনার কথা বলে সেখানে পাঠান। খেমচং পাড়া থেকে প্রথম দিকে ভারী বর্ষণের কারণে কেউ যেতে রাজি হচ্ছিল না। তবে একটা পর্যায়ে পাড়ার আটজন যেতে রাজি হয়।

তাদের পাঠিয়ে দিয়ে বর্ষারা বের হন নেটওয়ার্কে খোঁজে, অনেকটা পথ হেঁটে মোবাইল নেটওয়ার্ক পান তারা। রাত ১০টার একটু আগে রাফির ঘনিষ্ঠজন মোহাম্মদ হাসান মুরাদকে দুর্ঘটনার কথা মোবাইল ফোনে জানানো হয়। মুরাদের মাধ্যমে আলিকদম গাইড সমিতির মিন্টু, স্থানীয় ব্যবসায়ী জমির, আলিকদম উপজেলা চেয়ারম্যানসহ আরো অনেকের কাছেই খবর পাঠানো হয়। খবর পাঠানো হয় সেনাবাহিনী ক্যাম্পেও। যোগাযোগের জন্য বর্ষারা অনেকটা সময় নেটওয়ার্ক জোনে ছিলেন।

সেনাক্যাম্প থেকে লোকেশন জেনে টিমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। ওদিকে বর্ষারা পাড়ায় ফেরেন রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে। বর্ষা এবং আগে ফেরত আসা টিম মেম্বাররা রাফি বেঁচে আছেন এবং তাকে নিয়ে ফেরা হচ্ছে বলেই তখনো জানতেন।

রাফিকে উদ্ধার করতে যাওয়া পাহাড়ি লোকগুলো তার মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পেরে লাশ রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। মুরং জাতিগোষ্ঠীর রীতি- তারা রাতের বেলা লাশ স্পর্শ করে না এবং পাড়াতেও লাশ রাখে না। তারা ফিরে আসবে জানালে রাফির সাথে থাকা টিম মেম্বারও তার কাছে থাকার সাহস পাচ্ছিল না। তখন লাশ পঞ্চ (রেইনকোট) দিয়ে পেঁচিয়ে ও হ্যামকে বেঁধে রেখে পাড়ায় ফিরে আসে তারা।

মাঝ রাতে রাফির সাথে যারা ঝিরিতে ছিল, তারা আগে পাড়ায় ফিরে আসে। রাফির বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা ঠিকমত উত্তর দিতে পারছিল না। ‘নিয়ে আসতেছে, নিয়ে আসবে’ এমন সব উত্তর দেয়া হচ্ছিল।

রাত ২টার দিকে রাফিকে উদ্ধার করতে যাওয়া পাড়ার লোকগুলোও ফিরে আসে। তারা বর্ষাকে জানায় যে ফেরার পথে একটা জুমঘরে রাফিকে রেখে আসা হয়েছে। জোঁক আর বৃষ্টির জন্য কোনোভাবে আনা যায়নি। তখনো বর্ষাকে মৃত্যুর কথা জানানো হয়নি। বর্ষার আর আবির আবারো রাফির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ‍দুর্গম পথে হেঁটে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তাদের সাথে যাওয়া সাহস আর কেউ দেখায়নি। বৈরী আবহাওয়া বর্ষারাও আর যেতে পারেননি।

সেনাবাহিনী তৎপর হয়ে মেনিকিউ পাড়া থেকে রাতের ১২টায় চারজনের টিম পাঠায় খেমচং পাড়ার উদ্দেশে, তারা সেখানে পৌঁছায় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে। পরে পাড়ার লোকজনসহ ১৬-১৭ জনের একটা টিম বের হয় রাফিকে উদ্ধার করতে। এই সময়টাতে কোনোভাবে বর্ষা ও আবির রাফির মৃত্যুর কথা জেনে যান।

রাফির আহত হওয়া ও তাকে উদ্ধার করার বিষয়টা বর্ষা ও আবিরের উদ্ধৃতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন মোহাম্মদ হাসান মুরাদ।

পাহাড়কে ভালোবেসে মানুষকে পাহাড় দেখানোই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন রাফি। তিনি স্বেচ্ছাসেবী কাজের সাথেও যুক্ত ছিলেন। নিয়মিতই মুমূর্ষ রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহ নিয়ে কাজ করতেন। শেষ বেলাতে পাহাড়ে রক্ত ঝরিয়েই তার মৃত্যু হলো।

রাফির মৃত্যু পাহাড়প্রেমীদের মনে দাগ কেটে গেল, অনেক কিছু শিখিয়েও গেল। ফেসবুকে পাহাড়প্রেমীদের লিখতে দেখা গেছে, ‘পাহাড়ে আর কেউ না হারাক, পাহাড় আর শোকের জায়গা না হোক।’