রহস্যময় ড্রাগনের আস্তানা : বগা লেকের মিথ, ইতিহাস ও ভ্রমণকথা

লেখা : রোহান মাহমুদ
আজ থেকে প্রায় ২ হাজার বছর আগের কথা। স্থানীয় লোকেরা আঞ্চলিক ভাষায় জায়গাটাকে ‘সাক থাই প্রু’ নামে ডাকতেন। সনাতন শব্দটিকে বাংলা করলে ভাবানুবাদ দাঁড়ায়, ‘'খুম রাজার রাজ্য’। সবুজে ছায়া, দুর্গম সব পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট একটি এলাকা। সে পাহাড়ের আদিম কোলে বাস করত স্থানীয় মানুষেরা। ম্রো, বম, তঞ্চঙ্গ্যাসহ আরো বেশ কিছু সম্প্রদায়ের আবাস ছিল সেখানে।
হঠাৎ করে সেসব গ্রাম থেকে হারিয়ে যেতে থাকে গবাদিপশু আর ছোট ছোট বাচ্চা। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে গ্রামপ্রধান, সাধারণ মানুষসহ সবাই। পাহাড়গুলোর মাঝে চোঙাকৃতির একটি রহস্যময় পাহাড় ছিল। এই পাহাড়টির আকৃতি ছিল সব পাহাড় থেকে আলাদা। খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল, বাচ্চাগুলোর কিংবা গবাদিপশুর সর্বশেষ পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে ওই চোঙা আকৃতির পাহাড়ে।
সবাই ধারণা করতে শুরু করল, অতিপ্রাকৃত কিছু একটি বাসা বেঁধেছে রহস্যময় ওই পাহাড়ের কোলে, তারই আক্রমণের শিকার হচ্ছে নিরীহ এই প্রাণী আর বাচ্চারা। আসল রহস্য উদঘাটন করতে এগিয়ে আসে গ্রামের একদল সাহসী পুরুষ। তারা চোঙা আকৃতির পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখে, আকাশ থেকে নেমে এসেছে আজব এক প্রাণী।
এমন কোনো প্রাণী যে পৃথিবীতে থাকতে পারে, স্থানীয়রা তা কল্পনাও করতে পারেনি। বিশাল পাখাওয়ালা সেই প্রাণী যখন-তখন আগুনের হলকা বের করে ধ্বংস করে দিতে থাকে আশেপাশের গাছপালা। প্রচণ্ড ঘাবড়ে যায় তারা। কী করে এই উদ্ভট জীবটিকে খুশি করা যাবে, সে উপায় খুঁজতে থাকে গ্রামবাসী। ইতোমধ্যে ড্রাগনটি চোঙা আকৃতির ওই গুহায় নিজের আস্তানা বানিয়ে নেয়।
এলাকার লোকজন তার নাম দেয় ‘বগা’। বগাকে খুশি করতে নিয়মিত বিভিন্ন জীবজন্তু ধরে নিয়ে উপঢৌকন হিসেবে পরিবেশন করতে থাকে তারা। বেশ নিরুপদ্রবভাবেই দিন কাটতে থাকে সবার। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন টেকেনি। কিছু দিনের মাঝেই আবারো গ্রামের শিশুরা নিখোঁজ হতে থাকে একের পর এক।
শুরুতে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়কে দোষারোপ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা টের পায় যে এটি কোনো নির্দিষ্ট গোত্রের সাথে নয়, বরং সবার সাথেই ঘটছে। এবার সবার সন্দেহের তীর এসে পড়ে বগার দিকে। বগাকে উৎখাত করতে না পারলে বাঁচানো যাবে না শিশুদের, এটুকু বুঝতে কারো বাকি থাকে না। কাজেই প্রতিটি গোত্র থেকে বেছে বেছে সাহসীদের নিয়ে গঠন করা হলো একটা দল।
যুদ্ধ করেই হোক আর নিজের জীবনবাজি ধরে ড্রাগনের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েই হোক- শিশুদের তারা উদ্ধার করে আনবেই, এই ব্রত নিয়ে বেরিয়ে গেল যোদ্ধারা। তীর, ধনুক, বল্লম, লাঠি আর মশাল হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা হানা দিল বগার গুহায়। গুহার মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষের রক্ত আর হাড়গোড় দেখে তারা বুঝে নিলো কী ঘটেছে এখানে।
ক্ষেপে গিয়ে একসাথে ঘুমন্ত বগার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকরা। কোনো জাদুবিদ্যা দেখানো বা আগুনের ফোয়ারা ছিটানোর আগেই বগাকে কুপোকাত করে ফেলল সবাই মিলে। এতজন যোদ্ধার সাথে না পেরে কোনোমতে গা ঝাড়া দিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজতে লাগল সে। যে রথে করে একদিন তার উদয় ঘটেছিল পাহারের চূড়ায়, সেই রথে উঠে পালানোর চেষ্টা করল বগা। কিন্তু গ্রামের ক্ষিপ্ত যুবকরা বগার রথে আগুন ধরিয়ে দিলো।
যোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়া সে আগুনে পুড়ে মরল বগা। তবে তার আগে শেষবারের মতো মুখ থেকে আগুনের ফোয়ারা ছুটাল সে। সেই আগুনের তাপে আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে থর থর করে কেঁপে উঠল চোঙা আকৃতির পাহাড় আর বগার তৈরি করা গুহা। ভেঙে পড়তে শুরু করল পাহাড়।
এই ভূমিকম্পের কারণেই সেখানে তৈরি হলো বিশাল এক গর্ত। অচিরেই বৃষ্টির পানিতে ভরে ওঠে গর্তটি। এরপর থেকে বাইরের কোনো সাহায্য পাওয়া না গেলেও, এই লেকের পানি কখনো শুকায়নি। প্রতি বসন্তে হ্রদের স্বচ্ছ পানি ঘোলা হয়ে যায় আর রঙ পরিবর্তন করতে থাকে। এই ঘটনা স্থানীয়দের বিশ্বাসকে আরো বদ্ধমূল করে তোলে আর তার সাথে সাথে আরো নানা ধরনের উপকথার জন্ম দেয়।
প্রিয় পাঠক, আপনারা কী ধরতে পেরেছেন, আমি ঠিক কোন লেকটির ইতিহাস বলছিলাম? ভ্রমণপিপাসুদের খুব পছন্দের ‘বগা লেক’ (বান্দরবান), এর সৃষ্টি নিয়ে বহুল প্রচলিত মিথ এটি।
সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি বান্দরবান আর সেখানকার প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি বগা লেক, দ্য লেক অফ মিস্ট্রি বা ড্রাগন লেক নামেও সুপরিচিত এটি। যুগে যুগে অভিযাত্রিকদের তা আকৃষ্ট করেছে দুর্নিবারভাবে। বগা লেকের আসল নাম ‘বগাকাইন হ্রদ’, যা স্থানীয়ভাবে ‘বগা লেক’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ এটি।
কেওক্রাডং পর্বতের গা ঘেঁষে, বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বগা লেকের অবস্থান। প্রশাসনিক হিসেবে হ্রদটি রুমা উপজেলায় পড়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় লেকটি। ফানেল বা চোঙাকৃতির আরেকটি ছোট পাহাড়ের চুড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কথা মনে করিয়ে দেয়।
উৎপত্তিগত দিক থেকে, বগা শব্দটি নেয়া হয়েছে ‘বাগা’ থেকে। বাগা অর্থ রাগান্বিত ড্রাগন।
এবার আসা যাক বগা লেকের উৎপত্তি সম্পর্কে ভূতাত্ত্বিকেরা কী বলছেন, সে প্রসঙ্গে। তাদের মতে, হয় মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ, নয়তো মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে বগা লেক।
এর পানি অম্লধর্মী। কোনো জলজ প্রাণীর পক্ষে এখানে বেঁচে থাকা সম্ভব না। বাইরের কোনো পানি এখানে ঢুকতেও পারে না, আবার এর আশপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। কাজেই আশপাশে পানির কোনো উৎস না থাকলেও এই বিশাল জলরাশি কিভাবে সৃষ্টি হলো, তা এক রহস্যই বটে। তবে তার চেয়েও বড় রহস্য হচ্ছে বগা লেকের পানির রঙ পরিবর্তন।
প্রতি বছর অদ্ভুত কোনো এক কারণে বগা লেকের পানির রঙ কয়েকবার পাল্টায়।
এই অঞ্চল সম্পর্কে সর্বপ্রাচীন তথ্য পাওয়া যায় তুংগো সাম্রাজ্য-এর হাইসাওয়াদি রাজ্যের প্রথম সার্কেল প্রধান বা গভর্নর, তবাং শোয়েথী-এর দিনলিপি থেকে, যিনি ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে নিযুক্ত হন। ব্রিটিশ সরকার পঞ্চম বোমং, কং হ্লা প্রু-কে (১৭২৭-১৮১১) সার্কেল প্রধান বা গভর্নর চিহ্নিত এবং ষষ্ঠ বোমং, সাক থাই প্রুকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরবর্তী কালে, চিটাগং হিল ট্রাক্টস রেগুলাশন ১৯০০-এর মাধ্যমে তথা আইন প্রয়োগ করে এই অঞ্চলের স্বকীয়তার প্রকাশ করা হয়, যা এখনো পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
অলৌকিক সৌন্দর্যের বগা লেক নিয়ে রয়েছে অজস্র রহস্য। এর আশপাশে কোনো ঝর্ণা না থাকলেও, লেকের মতোই চারপাশের অন্যান্য জলাশয়ের পানির রঙেও দেখা দেয় একই পরিবর্তন। এর বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, লেকটির তলদেশে একটি উষ্ণ ঝর্ণা রয়েছে।
ঝর্ণা থেকে যখন পানি বের হয়, তখনই হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়। আবার পাহাড়িদের মধ্যে প্রচলিত ড্রাগন বা আগুনের মিথ অনুযায়ী অনেকেই একে মৃত আগ্নেয়গিরি বলে সন্দেহ করেন। এই মৃত আগ্নেয়গিরির প্রভাবেও লেকের পানির রঙে পরিবর্তন আসতে পারে। ঝর্ণা বা লেক কোনোটার গভীরতাই এখনো পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়দের মতে গভীরতা ২০০-২৫০ ফুট হলেও ইকো মিটারে ১৫১ ফুট পর্যন্ত গভীরতার হদিস পাওয়া গেছে।
অনেকেই ভাবতে পারেন এগুলো নিছকই গল্প। তবে যাহা রটে তাহার কিছু তো বটে! কাপ্তাই হ্রদ, মহামায়া হ্রদ, ফয়েজ লেক আরো কত হ্রদ তো আছে, কোনোটি নিয়েই তো এমন কাহিনীর প্রচলন নেই। সত্যিটা জানার তো আর কোনো উপায় নেই, আপাতত না হয় বহুল প্রচলিত এই মিথগুলোই জানা থাকুক আমাদের সবার।
কিভাবে যাবেন
প্রথমেই আপনাকে ঢাকা থেকে বান্দরবানে পৌঁছাতে হবে। বান্দরবান থেকে রুমায় চান্দের গাড়ি অথবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে যেতে পারবেন। রুমা থেকে জিপে করে বগা লেকে যেতে পারবেন। তবে রুমা থেকে অবশ্যই একজন গাইড নিতে হবে সাথে।
ঢাকার সাথে বান্দরবানের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। ঢাকা থেকে বাসে করে সরাসরি বান্দরবানে যেতে পারবেন।
খাবার সুবিধা
বগা লেকে থাকার জন্য কোন আবাসিক অথবা অনাবাসিক হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট নেই। তাই আপনাকে স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে খাবার, পানি ও অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র যোগাড় করতে হবে। আপনি দরকারি জিনিসপত্র অত্যন্ত সুলভ মূল্যে পেয়ে যাবেন।