চর ওসমান : প্রকৃতির এক অন্যরকম হাতছানি

abc

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ঘুরে বেড়ানো লোকজনদের ঈদের দিন বলা যায় সপ্তাহের এই দিনটিকে। এই টাইপের লোকজনের এই বৃহস্পতিবার অফিসে সময় কাটে অন্যদিনের চেয়ে একটু বাড়তি কাজ সামলানোর চাপে, যেন একদম সময়মতো অফিস থেকে বের হওয়া যায় এই আশায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

ফেব্রুয়ারি মাস। অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় গিয়ে কোনোমতো ফ্রেশ হয়ে, আগে থেকেই গোছানো ব্যাগ নিয়ে দৌড় দেই ফয়সালের অফিসে। সেখানে তার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দুজনে রওনা দেই সদর ঘাটের উদ্দেশে। আমাদের গন্তব্য নিঝুম দ্বীপ। 

নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ। এটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত। ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার পুরো দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে দ্বীপটি জাহাজমারা ইউনিয়ন হতে পৃথক হয়ে স্বতন্ত্র ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করে। নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিল চর ওসমান, বাউল্লার চর, আবার কেউ কেউ একে ইছামতীর চরও বলত। এ চরে প্রচুর ইছা মাছ (চিংড়ি) পাওয়া যেত বলিই এই নামে ডাকা হতো।

ওসমান নামের একজন বাথানিয়া তার মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম দ্বীপটিতে বসবাস শুরু করেন। তার নামেই প্রথম এই দ্বীপের নাম হয় চর ওসমান। মূলত বাল্লারচর, চর ওসমান, কামলার চর এবং মৌলভির চর- এই চারটি চর মিলিয়ে আজকের নিঝুম দ্বীপ।

প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একরের দ্বীপটি ১৯৪০ সালের দিকে জেগে ওঠে। ১৯৫০ সালের দিকে জনবসতি গড়ে উঠে। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটির প্রাণের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের পরে তৎকালীন হাতিয়ার নেতা আমিরুল ইসলাম কালাম সাহেব দ্বীপটিতে পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই, তাই তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘ছিলেন হায় নিঝুম!’ সেখান থেকে দ্বীপটির নতুন নাম নিঝুম দ্বীপ।

তবে এসব কথা লোকমুখেই শোনা।

এটি আমার জীবনের প্রথম লঞ্চ যাত্রা এবং নৌপথে এত দীর্ঘ সময় জার্নি। আমি অনেক এক্সাইটেড ছিলাম। বিকেল ৪টায় সদরঘাট পৌঁছে হাতিয়ার লঞ্চে উঠে পড়লাম। লঞ্চের দো’তলার ডেকে বাকি টিম মেম্বারদের জন্য জায়গা রেখে অপেক্ষা করছিলাম তাদের জন্য। হুট করেই দেখি মেহেরজান আপু হাজির শাড়ি পরে। একে তো সুদূর টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার সদরঘাট, তার ওপর সদরঘাট থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ার সেই নিঝুম দ্বীপ এবং সাথে বিশাল ব্যাকপ্যাক। এত লং জার্নি আপু শাড়ি পরে করবে এই ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লাগল।

আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, আশ্চর্যজনকভাবে ভ্রমণপ্রেমী এক বড় ভাই মিরাজুল ইসলাম সাব্বির আমাদের সারপ্রাইজ দিতে চলে এলেন। ভাইয়া সেবার আমাদের ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন না, তবে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। আমরা আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম, ভাইয়া বিদায় নিলেন। একে একে টিমের বাকিরা আসতে শুরু করল।

একদম শেষ মুহূর্তে হলো বিপত্তি। টিমের তখনও ৪ জন আসেনি, এই দিকে লঞ্চ ছাড়ার সময় প্রায় ছুঁই ছুঁই। লঞ্চ ছাড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তুশি আপু আর অপরূপা আপু এসে পৌঁছালেও রাশেদ ভাই আর প্রশান্ত দাদা তখনও অনেক দূর।

ফয়সাল, হাসনাত ভাই, রিপন ভাই নিচতলায় তাদের রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে আর দোতলায় আমার এবং মেহেরজান আপুর টেনশনে নাভিশ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থা।লঞ্চ ছাড়ার পর নৌকা দিয়ে এসে মাঝনদীতে লঞ্চে উঠতে পারে রাশেদ ভাই আর দাদা। অবশেষে টিমের সবাই লঞ্চে উঠত পারলো,

আমরাও স্বস্তি পেলাম। চলছে আমাদের আড্ডাবাজি।

প্রথমবারের মতো লঞ্চ জার্নি, আমি ঘুরে ঘুরে লঞ্চের পরিবেশ দেখছিলাম। এই দিকে ঢাকায় শীতের আমেজ কমতে শুরু করলেও রাত বাড়ার সাথে সাথেই মনে হলো এ যেন পৌষ মাসের হাড় কাঁপুনি শীত। কনকনে ঠান্ডায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম লঞ্চের ছাদে। ঠান্ডা বাতাস, দূরের ওই তীরে ছোট ছোট জোনাকীর আলোর মতো করে জ্বলছে তীরবর্তী শহরের লাইটগুলো। মাঝ নদীতে অসংখ্য জেলেদের নৌকায় টিমটিম করছে তাদের জীবিকার আলো। রাতের ওইরকম অনিন্দ্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে জীবনের অনেক হিসাব মিলিয়ে নিলাম। 

রাত বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ঘুমানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। একটা সময় চারপাশটা নিরব হয়ে গেল, সবাই আধো আধো চোখে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাতে শুরু করছে। মাঝেমধ্যে থেকে থেকে আওয়াজ ভেসে আসছিল, ডেকে ভ্রমণ করার অনেক মজার অভিজ্ঞতা যুক্ত হলো আমার ঝুলিতে। এভাবেই আমাদের রাতটা কেটে গেল। 

সকালে যখন ঘুম ভাঙলো দেখলাম নাম না জানা এক ঘাটে লঞ্চ ভেড়ানো, মালামাল নামানো হচ্ছে, যাত্রী ও মালামাল নামানোর পর আবার যাত্রা শুরু করল। ভোলার মনপুরা ঘাটে পুনরায় ভিড়ল, সর্বশেষ ঘাট ছিল হাতিয়া এবং আমরা সেখানেই নেমে গেলাম।

শীতের কুয়াশা ভেদ করে ততক্ষণে উকি দিচ্ছিল সকালের মিষ্টি রোদ। আমরা হাতিয়ার লঞ্চ ঘাটেই সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে বড় একটা মাছ ধরার ট্রলারে করে রওনা দেই নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে।

সময়ের সাথে সাথে রোদের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে, আমরাও রোদে পুড়ে পুড়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ট্রলার জার্নি শেষ করে পৌঁছাই চর ওসমানে (নিঝুম দ্বীপ)।

নিঝুপ দ্বীপের নামারবাজারে আমরা হালকা নাস্তা করে সরাসরি চলে যাই আমাদের ক্যাম্প সাইটে। সেখানেই নিজেদের তাঁবু টানিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা চলে যাই সৈকতে গোসলের জন্য। তখন জোয়ার চলছিল, আর নিঝুপ দ্বীপের এই সমুদ্রের পানিতে বালুর চেয়ে কাদামাটি বেশি। দূর্ভাগ্যবশত আমাদের ফিরে এসে টিউবওয়েলেই গোসল সারতে হলো।

আমরা দুপুরের খাবারের জন্য যাই নামার বাজারে, যা আমাদের ক্যাম্প সাইট থেকে মোটামুটি পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের হাঁটার পথ। যে হোটেলে খাই সেখানকার খাবারের প্রশংসা না করলেই নয়। টেংরা মাছ আর চিংড়ির ভুনা টা জাস্ট অমৃত ছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা ক্যাম্প সাইটে ফিরে আসি। যে যার মতো তখন সবাই বিশ্রাম করে, কেউ কেউ ঘুমিয়ে নেয় অল্প করে।

সূর্য মামা যখন পশ্চিমের আকাশে ঢলে পরে, আমরা সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই খেজুর বাগানে। সেখানে বেশ কিছু সময় আড্ডা দিয়ে, ছবি তুলে আমরা ক্যাম্প সাইটে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছিল। মাথার উপর রুপালী চাঁদেরও অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। একপাশে বিস্তৃর্ণ বালুচর, বিপরীতে শান্ত একটা সমুদ্র এবং আকাশে মস্তবড় এক ঝলসানো চাঁদ। আমরা হাঁটছি, কখনও গল্প করে, কখনও বা নিঃশব্দে।

ক্যাম্পে ফিরে যে যার মতো সময় কাটাতে ব্যস্ত সবাই। কেউ কেউ হ্যামকে দোল খাচ্ছিল, কেউ কেউ আবার সময় কাটাচ্ছিল বই পড়ে। গল্পে, আড্ডায় আর গানে রাতের খাবারটা সেরে আমরা ঘুম দেই। কেননা সকাল সকাল উঠার তাড়া ছিল আমাদের। 

পরদিন ভোর ৪টায় সবাই ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে বসে থাকি অটোরিকশার অপেক্ষায়। এত সকালে ঘুম থেকে উঠার একটাই উদ্দেশ্য, আমাদের তা হলো হরিণের দেখা পাওয়া।

লোকালয়ে হরিণ পাব না, তাই আমরা চলে গেলাম নিঝুম দ্বীপের জাতীয় উদ্যানে। হরিণের দেখা না পেলেও আমরা নিরাশ হইনি। সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশ, বনের ভেতরে পাখিদের কিচিরমিচির আর প্রকৃতির নিস্তব্ধতা আমাদের মুগ্ধ করেছিল। আমরা উদ্যান থেকে ফিরে যাই পালকির চরে। চরটা একেবারেই জনমানবশূন্য। একপাশে বিশাল ঝাউবন এবং অপর পাশেই সমুদ্র। কিন্তু সে সমুদ্রে পা ভেজাতে হলে হাঁটতে হবে কয়েক কিলোমিটার পথ। ভাটার কারণে পানি নেমে গেছে। সেখানে কিছুটা সময় পার করে আমরা আবার ফিরে আসি নামার বাজারে।

সকালের নাস্তা করে আমরা চলে যাই ট্রলারে করে চৌধুরী খাল। দু’পাশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সৌন্দর্যকে ভেদ করে একদম বনের ভেতরে চলে গেছে এই চৌধুরী খাল। বনের বেশ ভেতরে গিয়ে সুবিধাজনক জায়গা দেখে আমরা ট্রলার ভিড়াই। ট্রলার থেকে নেমে ঢুকে যাই বনের মধ্যে। বেশ সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাই আমরা।

কমলার দিঘি ঘুরে আমরা আবার বনের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় অভিযান চালাই হরিণের সন্ধানে, কিন্তু তখনও আমরা হতাশ হই। সেখান থেকে আমরা যাই কবিরাজের চর। ভীষণ সুন্দর জনমানবশূন্য এ চর। কিছু সময় ঘুরাঘুরি করে আমরা ফিরে আসি ক্যাম্প সাইটে। দুপুরের খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা ক্যাম্পের পাশের সমুদ্র তীরে আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।

এদিকে শুরু হয়ে গেল আমাদের বারবিকিউ পার্টির আয়োজন ও ক্যাম্প ফায়ারিং। রাতের খাবার শেষ করে আবার শুরু আড্ডাবাজি। আমি অনেক ক্লান্ত থাকায় তাঁবুতে ঢুকেই ঘুম দেই, টিমের বাকিরা নামার বাজারে ও বিচে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছিল রাতের এক-তৃতীয়াংশ।

পরের দিন সকালে আমাদের ঘরে ফেরার তরজোড় শুরু হয়ে যায়। একটুখানি মন খারাপ ও লাগছিল সবার। বেশ ভালো আড্ডায়, গানে সময় পার করেছিলাম আমরা। 

সব গুছিয়ে আমরা চলে যাই বন্দরটিলা বাজারে। নাস্তা করে আমরা অপেক্ষা করি ট্রলারের। সকাল ৯টায় ট্রলার ছাড়ার কথা থাকলেও ১০টার কাছাকাছি সময়ে ট্রলারের মাঝি জানায়, তারা এখনি যাবে না, আরো অনেক দেরি হবে। এইদিকে দুপুর ১টায় আমাদের ঢাকায় ফেরার লঞ্চ হাতিয়া থেকে।

আমাদের হাতে মাত্র তিন ঘণ্টা সময়, অথচ আমরা তখনও নিঝুম দ্বীপ থেকে বের হতে পারিনি। উপায় না পেয়ে নদী পার হয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রওনা দেই হাতিয়া। সবার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ, লঞ্চ মিস হলে বিপদেই পড়তে হবে আমাদের। পরের দিন সবারই অফিস। টেনশনে টেনশন আড়াই ঘণ্টা পর আমরা হাতিয়া লঞ্চ ঘাট পৌঁছাই। ততক্ষণে একটা লঞ্চ ছেড়ে দিলেও আমরা পরের লঞ্চটা পেয়ে যাই, যা দুপুর ১টায় ছাড়ে। 

আমরা লঞ্চে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার লঞ্চেই সেরে নেই। যাওয়ার সময়ের জার্নিটা রাতে ছিল, ফেরার সময়ের জার্নি দিনে। দুইরকম অভিজ্ঞতা। মাঝ নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগে, জল ও জেলেদের দারুণ মিতালী দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে। সারারাতের জার্নি শেষ করে ভোর ৪টায় আমরা সদরঘাটে পৌঁছাই। 

আমরা অসংখ্য স্মৃতি জমাই, মূহূর্তগুলোকে যত্নে ধারণ করি মন এ মননে। একদিন বুড়ো হবো, কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবাতে ডুবাতে হয়তো আমরা গল্পে মেতে উঠব এসব সুখে থাকার দিনগুলোর স্মৃতিচারণে। এই গুলোই আমার সম্পদ, আমার নিজস্ব সম্পত্তি।