নেপালি দু’ শ রুপি!

ভ্রমণ মানুষের মানসিক অবস্থার কতটা পরিবর্তন করে তা ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের বুঝানোর প্রয়োজন নেই। তবে সব ব্যাপারেই কিছু ভিন্নতা থাকবে এটা স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই।
ভোর তখন সাড়ে ৫টা। নেপালের পোখারা থেকে রাতের বাসে কাঠমান্ডুর থামেলে এসে নামলাম। বাংলাদেশে আমার ফেরার ফ্লাইট আজই দুপুর সাড়ে ১২টা। হাতে সময় প্রায় ৭ ঘণ্টা। আমাকে ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে হবে অন্তত আড়াই ঘণ্টা আগে। অর্থাৎ ১০টার মধ্যেই।
গাড়ি থেকে নেমেই হোটেলের যাওয়ার জন্য সবাই টেক্সি নিলাম। নির্ধারিত হোটেলের সামনে নামলাম। লবিতে ব্যাকপ্যাক রেখে ফ্রেস হলাম। বলে রাখা ভালো, আজ আমাদের টিমের শুধু আমারই ফ্লাইট। তাই বাকিদের প্লান অনুযায়ী তারা হোটেলের রুমে চলে গেলেন। এর মাঝে আমার সব হিসাব শেষ করলাম আমার টিম লিডারের সাথে। হাতে থাকল ৪২৫ নেপাপি রুপি। আমার টিম লিডার আর টিমের বড় আপু নীরা আমাকে তাদের রুমে রেস্ট নেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু আমি মনে মনে প্লান করেছি অন্য কিছুর।
আমি আসলে খুব ভোরে থামেলের রাস্তার সৌন্দর্য মিস করতে চাইনি। তাই রেস্ট করবার ফুরসত নেই।
হোটেলের সামনেই এক দিদি চা বিক্রি করছেন দেখে এগিয়ে গেলাম। বললাম, দিদি এক কাপ চা দে দো। ২৫ রুপি নিলেন এক কাপ লাল চা দিলেন। আমার ৩২ বছরের জীবনে এত স্বাদের লাল চা আগে কখনো খাইনি।
থামেলের রাস্তায় তখনো রাতের স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলছে। দরবার স্কয়ার আমার বর্তমান অবস্থান থেকে ১.৪ কিলোমিটার দূরে দেখাচ্ছে ম্যাপে। দোকানপাঠ সব বন্ধ। তবুও মনে হচ্ছে এ শহর ঘুমায়নি।
লবিতে বসেই প্লান করেছি আজকের ব্রেকফাস্ট করব দরবার স্কয়ারে বসে। মাথায় চাপ অনুভব হলো কোনো এক অনিবার্য কারণে। চাপ নিয়ে চিন্তা না করে হাঁটা শুরু করি।
সকাল ৬টা ৩৩। হাঁটছি একটা কফি শপের খোঁজে। সকালে কফি মিস নেই। চা তো এক কাপ পান করেছি, কিন্তু কফি আমার লাগবেই। ৫ মিনিট হাঁটার পরেই একটা কফি শপ পেলাম, বেকারি আইটেমও ছিল। এক কাপ ফফি আর একটা croissant নিলাম। বিল ২০০ রুপি। থাকলো ২২৫ রুপি। হাঁটতে হাঁটতে দরবার স্কয়ারে খুব কাছে লোকাল ফুড দেখলাম। নিলাম একটা সিল আর একটা মালপা। ২৫ রুপি খরচ করতে হলো এখানে। সিল দেখতে বড়সড় ডোনাট টাইপের আর মালপা হলো বাংলাদেশের তেলের পোয়া পিঠা টাইপ।
দরবার স্কয়ারে ঢুকতেই যাব, সেখানে দেখলাম সকালের পূজার জন্য ফুল বিক্রি করছে দিদিরা। মুহূর্তেই মনে হলো এখানে যেন রঙের আগুন লেগেছে। অন্য দিকে ষাটোর্ধ এক চাচাকে দেখলাম রাই শাক ঝুড়িতে নিয়ে বসে আছেন, হাতে চায়ের কাপও ছিল। জিজ্ঞেস বললাম, ক্যাসে হে আপ...। নির্মল এক হাসিতেই উত্তর পেয়ে গেলাম।
খুবই সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপন দেখলাম। সকাল সকাল মনটা শান্তিতে ভরে উঠল।
খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বেঞ্চে বসে রইলাম। কোথাও বসে লোকজনের মুভমেন্ট দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। এক ঝাঁক কবুতরের মেলা বসেছে তাই দেখছি। রোদের দেখা আজ নেই। সময় হাতে কম। ফিরতে হবে হোটেলে, সেখান থেকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে যেতে হবে এয়ারপোর্টে। সকাল ৭.৪৮ এ সেখান থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করি। হঠাৎ মনে হলো আমার পকেটের দুর্দশার কথা। মাত্র ২০০ রুপি।
আগের চাপ আবারো মাথায় এলো। এইবার এই ১.৪ কিলোমিটার পাড়ি দিতে দিতে আমি রাজ্যের হিসাব কষতে বসলাম। প্রথমে মাথায় এলো ২০০ রুপিতে কি আমি এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে পারব?
তখন মনে পরে গেল হোটেল কক্সবাজারের মালিকের (বাংলাদেশী) কথা। প্রথম দিন তার হোটেলে খেতে গিয়ে বাংলা টাকায় বিল দিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবতেছি উনাকে গিয়ে বলি ৫০০ বাংলা টাকা নিয়ে ৫০০ নেপালি রুপি দেন।
ধুর ছাই, তাই কি হয়?
নিজেই প্রশ্ন নিজেই উত্তর। মনে মনে হাসতেছি আর হাঁটছি। পরে মাথায় এলো আমি প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটেই যাব। অথচ তখনো খুড়িয়ে হাঁটছি। গত কয়েকদিন আমি হাঁটার ওপরেই ছিলাম। এবার সময় হিসাব করে দেখি ১০টার মধ্যে পৌঁছাতে পারব না। পায়ের অবস্থা ভালো থাকলে হয়ত সম্ভব হতো। সময় তখন সাড়ে ৮টা প্রায়।
টিমের কারো থেকে টাকা দিয়ে রুপি দেয়ার কথাও মাথা এলো। এসব ভাবতে ভাবতেই দেড় কিলোমিটার রাস্তাকে দেড় দিনের সমান করে ফেলেছি মনে হচ্ছিল।
হোটেলের সামনে আসতেই দেখি টিমের শাহীন ভাই চা-নাস্তা করতে নিচে আসছেন। আমাকে দেখেই বললেন, আপু চলেন চা খেয়ে আসি। একটু হেঁটেই একটা ছোট হোটেল পেলাম। উনি অনেক অনুরোধ করলেন নাস্তা করার জন্য। আমি বললাম, আমি নাস্তা করেছি, শুধু চা খেতে পারি।
অথচ আমার মাথায় তখনো রুপির চিন্তা ঘুরে। শাহীন ভাই কেমনে জানবেন মাথায় কী ঘুরে! কারণ তখন পর্যন্ত এটা শুধু আমার মাথায়ই ছিল। এদিকে সময়ও হয়ে যাচ্ছিল এয়ারপোর্ট যাওয়ার। খাওয়া শেষ করে হোটেলের লবিতে যাই। সকল চিন্তাকে বিদায় দিয়ে শাহীন ভাইকে বললাম, শাহীন ভাই আমার ২০০ টাকা নিয়ে আপনার ২০০ নেপালি রুপি দেন আর আমাকে মেইন রোড থেকে বাইকে উঠিয়ে দেন।
উনি এক গাল হেসে বললেন আরে ২০০ টাকা লাগবে না, আপনি আমার দেশী মানুষ রাখেন তো। চিন্তার বোঝাটা থামেলেই নামলো। আমি জোর করে ভাইয়ার হাতে ২০০ টাকা দিলাম। এবার হাতে ৪০০ রুপি।
তারপর উনি আমাকে একটা বাইক ঠিক করে দিয়ে বিদায় দিলেন। আমিও আরামছে জ্যাম বিহীন রাস্তা পাড়ি দিলাম মোটরবাইকের পেছনে বসে।
আন্তরিকতার সাথে বাইকের চালক আমাকে ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিলেন মাত্র ১৫০ রুপির বিনিময়ে। আমি তো খুব খুশি কারণ, আমার কাছে আরও ২৫০ রয়েই গেছে।
সময় সকাল ১০টা ৫৫, সকল ফর্মালিটি শেষে এয়ারপোর্টে বসে বসে ওই ২০০ নেপালি রুপি নিয়ে ভেবেই চলেছি।
এবং বাকি ২৫০ রুপি আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে।